করোনা অতিমারি এবং পুঁজিবাদ (সপ্তম অংশ)

By : Update Study Group | : 19 July, 2021
করোনা অতিমারি এবং পুঁজিবাদ (সপ্তম অংশ)

অন্তিম পুঁজিবাদের সংকট

এই মুহূর্তে সমগ্র বিশ্বে এক কোটি চল্লিশ লক্ষের বেশি মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, মৃত ছয় লক্ষের বেশি। প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ সংক্রামিত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মানুষ। ভারতবর্ষে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং পরিস্থিতি ক্রমশ আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ভারতবর্ষ তো বটেই, এমনকি উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির স্বাস্থ্যব্যবস্থা উদ্ভূত পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারছে না। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসংস্থা ‘হু’ ১৩ জুলাই নতুন করে সতর্কবার্তা দিয়েছে: ‘পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে’। কিছু দেশের শাসকবর্গ স্তব্ধ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার মরিয়া প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিক ও স্বাভাবিক কার্যকলাপ আপাতভাবে আধা বা সিকিভাগ চালু করে দিয়েছে যার মধ্যে ভারতও আছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যাপক পরিমাণ সংক্রমণ ও মৃত্যু, চিকিৎসার জন্য হাহাকার, লকডাউনের ফলে কোটি কোটি মানুষের কাজ হারানো, পরিযায়ী শ্রমিকদের হাজার মাইল হেঁটে ঘরে ফেরা ও ফেরার পথে মৃত্যু, গ্রামাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ উদ্বৃত্ত শ্রমিকের ভীড়, কাজ না পাওয়া, মজুরি না পাওয়া, যৎসামান্য সঞ্চয় শেষ হয়ে যাওয়া, আধপেটা থাকা কিংবা অনাহার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়া ভারত তথা বিশ্বব্যাপী গভীরতম সংকট সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে রূঢ় বাস্তব হল, শীঘ্র এই সংকট লাঘব হওয়া দূরের কথা, বরঞ্চ সংকট ক্রমশ আরও ভয়াবহ ও ঘোরালো হয়ে উঠছে। ১৯১৮-১৯ সালের স্প্যানিশ এভিয়ান ফ্লু-তে ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল যা তখনকার বিশ্বের জনসংখ্যার ৫ শতাংশ। শুধু ভারতেই মারা গিয়েছিল প্রায় ২ কোটি মানুষ। (সূত্র ১) এবারের সংকট সেদিকেই এগোচ্ছে না কি আরও বৃহত্তর কোনও আকার নিতে চলেছে তা অনুমান করা এখন অসাধ্য।

কারও কাছে এই সংকট অর্থনৈতিক। কারও কাছে তা নিছক স্বাস্থ্যসংকট। এমনকি, প্রথম সংক্রমণের সাত মাস পরেও অনেকে এখনও চীনের চক্রান্ত, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ., কিংবা বিল গেটসের চক্রান্তের তত্ত্ব আউড়ে চলেছে। এখনও কেউ কেউ কৃষ্ণকায়, পীত, মঙ্গোলিয়ান অথবা মুসলমান জনগণকে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দায়ী করে চলেছে। এই সংকট কতটা গভীর ও জটিল, কেন এই সংকট সৃষ্ট হল তা নিয়ে অন্বেষণের প্রচেষ্টা এখনও বেশ দুর্বল, বহুলাংশে অবৈজ্ঞানিক ও বাস্তববুদ্ধিরহিত। বস্তুত, এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক পুঁজিবাদী ‘মানবসভ্যতার’ ঐতিহাসিক গমনপথে, অনেকটা অনিবার্যভাবে, অনিয়ন্ত্রিত গতিময়তায়।

গত দুই দশকে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ কীভাবে উদ্ভূত হয়েছে, কীভাবে তা মারণরোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার পরিসংখ্যান বলে দেয় কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। যেমন, ১৯৯৭-, ২০০৭-, ২০১৩- সালের এভিয়ান ফ্লু (যে রোগ এসেছে মুরগি, পাতিহাঁস, বুনোহাঁস থেকে); ১৯৯৮-তে নিপা ভাইরাস (বাদুর ও শুয়োর), সার্স ২০০২-০৪ (বাদুর), ২০১২ সালে মার্স (উট), ইবোলা ২০১৩-২০ (বাদুর, বাঁদর), ২০০৭ সালে জিকা (মশা) এবং বর্তমানে কোভিড-১৯ (বাদুর থেকে শুয়োর/প্যাঙ্গোলিন, সেখান থেকে মানুষ)। (সূত্র ২) বাদুর থেকে মুরগি-হাঁস-শুয়োরে ভাইরাসের সংক্রমণ এবং পোলট্রি ও শুয়োরের একফসলি বৃহদাকার চাষ থেকে তা মানবদেহে ছড়িয়ে পড়েছে। অথবা তা খোলা জীবন্ত মাংসের বাজার থেকে ছড়িয়েছে। কোনও চক্রান্ত নয়, ‘মানবসভ্যতার’ পুঁজিবাদী বিকাশের অনিবার্য ফলাফল এই অতিমারি।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বা বর্তমান নয়া উদারনীতি ও ভুবনীকরণের পর্যায়ে পুঁজিবাদী সঞ্চয়ন ও অতি মুনাফার উগ্র তাগিদে তথাকথিত উন্নয়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, খনিজ পদার্থের খনন, বৃক্ষ নিধন, জলাভূমি ধ্বংস ঘটে চলেছে নির্বিচারে। পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থা বনজঙ্গল কেটে সাফ করে দিয়েছে/দিচ্ছে, জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় কেটে রেলপথ-রাজপথ বানিয়েছে/বানাচ্ছে, মানুষের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের অতিচাহিদা বৃদ্ধি করে এবং পশুপাখির মাংসের ভোগলিপ্সা তৃপ্ত করতে সে বৃষ্টিধৌত অরণ্যের আরও অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছে, বাস্তুতন্ত্রকে নির্বিচারে ধ্বংস করেছে, বনের পশু-পাখি-উদ্ভিদের স্বাভাবিক ও আন্তঃসম্পর্কিত জীবনযাত্রা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে/দিচ্ছে, জলাভূমি বুজিয়ে ‘সভ্যতার’ ইমারত গড়েছে/গড়ছে, নদীর বুকে যত্রতত্র অসংখ্য বাঁধ দিয়ে তার স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করছে, ইত্যাদি। এই দানবীয় ধ্বংসকার্য সমাধা করার প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী সভ্যতায় মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে বন্য পশু-প্রাণির সংস্পর্শে এসেছে, তাদের থেকে বহন করে নিয়ে এসেছে ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া-পরজীবী। প্রাক-পুঁজিবাদী যুগের সাধারণ পশুপালন ব্যবস্থাকে (যা থেকেও মানুষ অতীতে মাঝেমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে) দানবাকার বহুজাতিক মাংস কর্পোরেশন ও তাদের এজেন্টরা ধ্বংস করে দিয়েছে। হয় বিশাল পশুখামার, না হয় নানা জাতীয় জীবন্ত প্রাণির মাংসের বাজার থেকে ভাইরাস নানা বাহকের মাধ্যমে (কখনও তারা বাদুর, কখনও প্যাঙ্গোলিন, কখনও মুরগি-হাঁস, কখনও শুয়োর, ইত্যাদি) মানবদেহে সংক্রামিত হয়েছে। উপর্যুপরি হারে বেড়েছে ধনী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা – যেখানে শোভা পাচ্ছে অরণ্য-নদী-সমুদ্রের দুষ্প্রাপ্য প্রাণি। এর ফলেও সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ছে।

চীনের উহানে এবং পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে কীভাবে বন্য প্রাণি থেকে মানবদেহে যথাক্রমে করোনা ও ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে সে প্রসঙ্গে এই রচনার চতুর্থ অংশে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আরও দু’টি দৃষ্টান্ত দিলে সম্ভবত বাহুল্য হবে না।

ক) ইঁদুর থেকে প্রাণঘাতী জ্বর: দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকায় ও অন্যত্র ১৯৬০-এর দশকে যে প্রাণঘাতী জ্বর (যেখানে রক্তবাহ নালি ফেটে যায়) দেখা যায় তা এসেছিল তীক্ষ্ণদন্ত ইঁদুর থেকে। জঙ্গল কেটে ফসল ফলানোর জমি প্রস্তুত হল, ঐ প্রকার ইঁদুরের বীজ, ঘাস ইত্যাদি অঢেল খাবার মিলল। কিন্তু জঙ্গল বিনাশের ফলে ইঁদুরভোজী বুনো কুকুর, জাগুয়ার, সাপ ও পেঁচার হয় নিধন ঘটল, অথবা তারা গভীর জঙ্গলে সরে যেতে বাধ্য হল। ফলে ইঁদুরের বংশবৃদ্ধি হল এবং তাদের মৃত্যুহার কমে গেল। তারা ক্রমশ জমি-সংলগ্ন লোকালয়ের কাছাকাছি এল, মানুষের সংস্পর্শে এল। তাদের দেহ থেকে জীবাণু সংক্রামিত হল মানবদেহে। বন্য প্রাণির স্বাভাবিক বসতস্থান ও বিচরণক্ষেত্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার মাধ্যমে জীবাণুর বিস্তার ঘটে তা অতিমারিতে পরিণত হল। (সূত্র ৩)

খ) এভিয়ান বা বার্ড ফ্লু: উৎপত্তি ঘটে হংকং-এ ১৯৯৭ সালে। পোলট্রির মুরগি সংক্রামিত হল পাতিহাঁস ও বুনোহাঁস থেকে। মুরগিগুলোকে অত্যন্ত সংকীর্ণ জায়গায় ঘনসন্নিবদ্ধ করে রাখার কারণে (সম্ভবত সব পোলট্রির চাষ এইভাবেই একফসলি পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়) ভাইরাস সমজিনসম্পন্ন এক মুরগি থেকে অন্য মুরগিতে দ্রুত পরিবাহিত হল। পোলট্রিতে কর্মরত শ্রমিক, বাজারে বিক্রেতা ও ক্রেতা, ইত্যাদিদের দেহে সেই ভাইরাস সংক্রামিত হতে বেশি সময় লাগেনি। (সূত্র ৪)

মানুষ প্রকৃতিরই অংশ। তার বাইরের কেউ নয়। মানুষ প্রকৃতির যেমন অন্যতম অঙ্গ – ঠিক তেমনই অন্যান্য বুনো পশুপাখি, সামুদ্রিক প্রাণি, উদ্ভিদ এবং নানা জীবাণুও তার অঙ্গ। এরা একে অপরের থেকে আলাদা, তাদের জীবনযাত্রা ভিন্ন, কিন্তু পরস্পর আন্তঃসম্পর্কিত। এদের নিয়ে গঠিত হয়েছে বহুবিচিত্র বাস্তুতন্ত্র। এই বাস্তুতন্ত্র এখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঘোরতর বিপন্ন। প্রাক-পুঁজিবাদী যুগে মানুষ কৃষিকার্য করেছে, জমি থেকে পুষ্টিদ্রব্য আহরণ করেছে, আবার মানুষ তার শারীরবৃত্তীয় বর্জ্য পদার্থ জমির মাটিতে ফিরিয়ে দিয়ে তাকে পুনরায় পুষ্ট করেছে। কিন্তু পুঁজিবাদী বিকাশের প্রক্রিয়ায় মানুষ যখন গ্রাম থেকে বেরিয়ে শহর নির্মাণ করল – ত্বরান্বিত হল আধুনিক শিল্পায়ন-নগরায়ণ-উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া – মানুষের ও তার পালিত পশুপাখির শারীরবৃত্তীয় বর্জ্য দ্রব্য আর গ্রামের মাটিতে ফিরে গেল না। তা শহরের আনাচেকানাচে জমা হল, জঞ্জাল তৈরি হল, কাঁচা বা অপরিকল্পিত পয়ঃপ্রণালীকে দূষিত করল, সেই দূষণ পৌঁছে গেল জলাশয়ে, নদী থেকে সমুদ্রে। জমির পুষ্টিদ্রব্য জোগান দেওয়ার জন্য তৈরি হল কৃত্রিম রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ইত্যাদির বৃহদাকার শিল্প। সেগুলি যত না ফলন বাড়াল, তার চেয়ে জমির ক্ষতি করল বেশি।

এইভাবে গ্রাম থেকে শহরের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছেদের পরিণামে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ‘সভ্য’ মানুষ প্রকৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। প্রকৃতি থেকে সে নির্বিচারে উন্নয়ন-শিল্পায়ন-নগরায়ণের নামে যথেচ্ছ মাত্রায় কাঠ-জল-খনিজসম্পদ-বন্যপশুপাখি সংগ্রহ করে চলল, বাস্তুতন্ত্রকে বিনষ্ট করল – পরিবর্তে সে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রায় কিছুই দিল না। বরঞ্চ সে প্রকৃতিকে দিল ক্রমবর্ধমান হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, সালফার-জাত যৌগ, দিল শিল্পজাত দূষণযোগ্য নানাবিধ বর্জ্য দ্রব্য। প্রকৃতির অন্যতম অঙ্গ বিভিন্ন বন্য প্রাণি-পাখি-মাছ তার কাছে অত্যন্ত উপাদেয় ভোগ্যপণ্য (প্রাক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তা ছিল বটে, কিন্তু বর্তমানের তুলনায় নগণ্য আকারে)। বন্য প্রাণিগুলিকে খাঁচাবন্দী করা হল, চাষ করা হল – ছোটখাটো চাষাবাদকে ক্রমশ গিলে খেল বহুজাতিক কর্পোরেশন – চাষ হল আরও নিবিড়ভাবে ও অত্যন্ত বৃহদাকারে। এক-একদিনে পশুখামারগুলি থেকে হাজার হাজার টন মাংস ও প্রক্রিয়াকৃত খাদ্য উৎপাদিত হল। বন্য প্রাণিদের স্বাভাবিক বাসস্থান ও বিচরণক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে গেল। অনেক বন্যপ্রাণি ভাইরাস-বাক্টেরিয়া-জীবাণুর বিপুল আধার। সেই আধারগুলিকে নির্বিচারে ঘাঁটা হল, তাদের স্বাভাবিক জীবনচক্রে মানুষের হাত পড়ল, ভাইরাস এক প্রাণি থেকে অন্য প্রাণিতে – কখনও মানুষে পরিবাহিত হল। সামগ্রিকভাবে বাস্তুতন্ত্র ব্যাপক পরিমাণে বিঘ্নিত হল। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির অনতিক্রম্য বিচ্ছেদ সৃষ্টি হল – মার্কসবাদীরা যাকে এখন বিপাকীয় ফাটল (বা বিচ্ছেদ) বলছেন। বলা বাহুল্য, এই বিচ্ছেদ সৃষ্টি হল পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত ও বিশৃঙ্খল বিকাশের ফলে। ফলে পুঁজিবাদ ও বাস্তুতন্ত্র (বা প্রকৃতি) পরস্পর বিরোধী দুই পক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

পুঁজিবাদ যেভাবে প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রকে বিনষ্ট করে যাচ্ছে তার ফলাফল দেখা যাচ্ছে ভীষণভাবে। বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়ছে দ্রুত হারে। জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে দ্রুত। খরা-বন্যা, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, সাইক্লোন-হারিকেন-টাইফুন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হরপা বান, পাহাড় বা মাটির ধস, ভূগর্ভস্থ জল ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়া, পাহাড়ের হিমবাহগুলির দ্রুত গলন, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়া, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে সুন্দরবন, মালদ্বীপ থেকে শুরু করে সমুদ্রোপকূলবর্তী শহরগুলির নিমজ্জিত হওয়ার সম্ভাবনা, বিভিন্ন পতঙ্গ ও পশুপাখির বিলুপ্তি, ইত্যাদি ক্রমশ এই গ্রহটাকে বেশ দ্রুত হারে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী মুনাফার সীমাহীন ক্ষুধা এবং অন্তর্নিহিত চাহিদা বা গতি তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে দিচ্ছে না, দিতে পারে না। প্রকৃতি ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব ক্রমশ হয়ে উঠেছে চরম ও অসমাধানযোগ্য। ফলে পুঁজিবাদ প্রকৃতির বিনাশ ঠেকাতে পারে না, তার জন্য প্রয়োজন ভিন্ন কোনও সমাজ ও উৎপাদনব্যবস্থা।

এককথায়, বর্তমান কোভিড-১৯ ভাইরাসের মারণ সংক্রমণের পিছনে আছে নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদের আগ্রাসী অভিযান। গত দুই দশকে একের পর এক ভাইরাস মহামারি এবং বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারি দেখাচ্ছে পুঁজিবাদ থাকবে, অথচ মহামারি ঘটবে না, কিংবা পুঁজিবাদ থাকবে, অথচ বাস্তুতন্ত্র ও প্রকৃতি ধ্বংস হবে না – এমন কল্পনা সোনার পাথরবাটি ছাড়া আর কিছু নয়।

বাস্তুতান্ত্রিক এই সংকটকে আরও ঘোরালো ও মারণাত্মক করে তুলেছে স্বাস্থ্যসংকট। নয়া-উদারনৈতিক পুঁজিবাদ জনকল্যাণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে গড়ে তুলেছে কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবস্থা। উন্নত পুঁজিবাদী ইউরোপীয় দেশগুলি তো বটেই, এমনকি ভারতের মতো পশ্চাৎপদ দেশগুলিতেও তারা সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অর্থের অভাবে শুকিয়ে মারছে, ক্রমশ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি ও কর্পোরেট সংস্থা পরিচালিত স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে। ভারতে স্বাস্থ্যখাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলে জিডিপি-র মাত্র ১.৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে যেখানে ‘হু’-র প্রস্তাবিত ব্যয় হল ন্যূনতম পক্ষে ৪ শতাংশ। এছাড়া, অতি মুনাফালোভী ওষুধ কোম্পানিগুলো হয় জীবাণু-প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন অথবা ওষুধের দাম করে তুলেছে এতটাই আকাশছোঁয়া যে পশ্চাৎপদ দেশগুলি দূরের কথা, উন্নত দেশগুলির বহু মানুষের কাছে তা আয়ত্তের বাইরে। ফলে টেস্ট, মাস্ক-স্যানিটাইজারের খরচ বা চিকিৎসার খরচ দূরস্থান, দিন আনি দিন খাই মানুষের কাছে কোভিড-১৯ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কালান্তক যম। ভারতের মতো দেশে কত শতাংশ গরিব শ্রমজীবী মানুষ কোভিড-১৯-এ সংক্রামিত হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু উন্নত দেশ, যেমন আমেরিকা-ব্রিটেনে দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণকায়, হিস্পানিক, এশিয়ান এবং শ্রমজীবী মানুষ সাধারণভাবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে অতীতে যে কোনও মহামারি বা অতিমারিতে গরিব মেহনতী মানুষের যেভাবে গণহারে মৃত্যু ঘটেছে, এখনও তার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। গরিব শ্রমজীবী মানুষের কাছে বড় দুঃসংবাদ হল বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন ভারতের কোনও কোনও রাজ্যে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে – যদিও সরকার তা স্বীকার করছে না। (সূত্র ৫) ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেসের তৈরি গাণিতিক মডেল বলছে আগামী অক্টোবর মাসের শেষে ভারতে সংক্রমণের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে, ২০২১ সালের মার্চে ৫.২৬ কোটিতে পৌঁছাবে এবং মার্চ মাসের মধ্যে ২৪ লক্ষের বেশি মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা! (সূত্র ৬) তাদের অনুমান বাস্তবায়িত হলে, বিশেষত ভারতের মতো দেশের রুগ্ন ও ধুঁকতে থাকা সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় গরিব শ্রমজীবী জনগণের কী অবস্থা দাঁড়াবে তা কল্পনাতে আনা যাচ্ছে না।

বাস্তুতান্ত্রিক সংকট (যার সঙ্গে ভাইরাস-সংকট ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত) এবং স্বাস্থ্যসংকটকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট। বস্তুত, নয়া-উদারনৈতিক পুঁজিবাদী বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছে তাদের মুনাফা ও ব্যবসা কতটা মার খাবে তার হিসেবনিকেশের উপর। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিবেদন জানাচ্ছে বর্তমান কোভিড-১৯ সংকটজাত অর্থনৈতিক মন্দা হতে চলেছে এমনই তীব্র যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সংকটের সঙ্গে তুলনীয়। বর্তমান সংকটের ফলে মাথাপিছু উৎপাদন নেমে যাবে ১৮৭০ সালের সংকটের মতো। উন্নতিশীল ও বিকাশমান দেশগুলির অর্থনীতি এতটাই সংকুচিত হবে যা গত ৬০ বছরে দেখা যায়নি। এমনকি বর্তমান সংকট হতে চলেছে ২০০৭-০৯ সালের আর্থিক সংকটের থেকেও দ্বিগুণ বেশি। (সূত্র ৭) প্রকৃতপক্ষে, কোভিড-১৯ অতিমারি শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে (এমনকি ভারতেও) মন্দার সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। ২০১৯ সালের জুন মাসে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছিল, ‘‘বিশ্ব মন্দা এখন আর শুধু আশঙ্কাই নয়, তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।… বিশ্বব্যাঙ্কের মতে বিশ্ব-বাণিজ্য গত দশ বছরে সবচেয়ে নীচে নেমে এসেছে।’’ (সূত্র ৮) বিশ্বখ্যাত অর্থনৈতিক রেটিং সংস্থা মুডিজ-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ গত বছরের অক্টোবর মাসে জানিয়েছিলেন, আগামী ১২-১৮ মাসের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে চলেছে। (সূত্র ৯) পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যাকে ব্যবসা চক্র (business cycle) বলে, তা যে আবার দেখা দিতে চলেছে এমন পূর্বাভাস ২০১৯ সালেই প্রকট হয়ে উঠেছিল। (সূত্র ১০) ফলে করোনা-সংকটের ধাক্কার ফলে শ্লথগতির বিশ্ব অর্থনীতি যে মুখ থুবড়ে পড়বেই তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের চেহারা ক্রমশ ভয়াবহ এবং অভূতপূর্ব হতে থাকলে তার কোপ যে বিশ্বের ব্যাপক গরিব শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে এসে পড়বে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে বিশ্ব শ্রম সংস্থা (আইএলও) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে ২০২০ সালের দ্বিতীয় আর্থিক ত্রৈমাসিকে সমগ্র বিশ্বে বেকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০০০০০০০০ বা ৪০ কোটি। (সূত্র ১১) বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা পড়বে বিশ্বের অসংগঠিত বা ইনফর্মাল ক্ষেত্রে, যা বিশ্বের জিডিপি-র এক-তৃতীয়াংশ ধারণ করে এবং যার সঙ্গে উন্নতিশীল দেশগুলির ৭০ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ যুক্ত। (সূত্র ১২) যে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হারকে কোনও দেশের উন্নয়নের প্রধান সূচক ধরা হয়, বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতে তার অবস্থা দাঁড়াবে খুবই করুণ। যেমন উন্নত দেশগুলির অর্থনীতি সংকুচিত হবে ৭ শতাংশ হারে। দক্ষিণ এশিয়ার (যার মধ্যে ভারত পড়ে) বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে -২.৭ শতাংশ, সাব-সাহারান আফ্রিকায় -২.৮ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় -৪.২ শতাংশ, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় -৪.৭ শতাংশ এবং লাতিন আমেরিকায় -৭.২ শতাংশ। (সূত্র ১৩) এপ্রিল মাসে ডবল্যু.টি.ও. জানিয়েছে করোনা-সংকটের মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় বিশ্ব-বাণিজ্য ১৩ শতাংশ সংকুচিত হবে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ৩২ শতাংশ! (সূত্র ১৪) ঐ এপ্রিল মাসেই রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য সংস্থা জানিয়েছিল, পৃথিবী এক ‘‘ক্ষুধা অতিমারির সামনে দাঁড়িয়ে আছে’’ এবং কয়েক মাসের মধ্যে আমরা ‘‘একাধিক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করব’’। উপরন্তু, তাদের মতে, বিশ্ব এমন এক মানবিক সমস্যার সম্মুখীন হবে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর দেখা যায়নি। প্রায় তিন ডজন দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। (সূত্র ১৫)

ইতিমধ্যে, বিশ্ব উৎপাদনমূলক অর্থনীতি যে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা (গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনস/ভ্যালু চেইনস)-র উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, তাতে সংকটের ছায়া ঘনীভূত হতে শুরু করেছে। ১৯৮০-৯০-এর দশক থেকে উন্নত বিশ্বের বৃহদাকার কর্পোরেশনগুলি তাদের মূল উৎপাদন-ব্যবস্থার সিংহভাগ সেই সব দেশে চালান করেছিল যেখানে শ্রমিকদের মজুরি উন্নত দেশের কয়েক ভগ্নাংশ মাত্র এবং জমির দামও ব্যাপক পরিমাণ সস্তা। ১৯৫০ সালে বিশ্বের শিল্প-শ্রমিকদের ৩৪ শতাংশ ছিল ‘কম উন্নত’ দেশসমূহে, ১৯৮০ সালে ছিল ৫৩ শতাংশ; ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯ শতাংশ। ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ৮৩ শতাংশ ছিল উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে কেন্দ্রীভূত। (সূত্র ১৬) জেনারেল ইলেকট্রিক, এক্সন, শেভ্রন, হিউলেট অ্যান্ড প্যাকার্ড, জেনারেল মোটর্স, আইবিএম, জনসন অ্যান্ড জনসন, অ্যাপল, ইত্যাদি বহুজাতিক কর্পোরেশনের শ্রমিকসংখ্যা তাদের নিজেদের দেশের চাইতে ঐ সব উন্নয়নশীল দেশে অনেক বেশি। এরা কোম্পানি পরিচালনা, বাজারিকরণ, আর্থিক ভার নিজেদের হাতে রেখে বিভিন্ন অংশ বা পার্টসের উৎপাদন, সেগুলি জোড়া লাগানো বা অ্যাসেম্বলিং, প্যাকেজিং, সরবরাহ, ইত্যাদির সিংহভাগ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে বিভিন্ন তুলনামূলক ছোট কোম্পানির হাতে। সেই কোম্পানিগুলো আবার সাব-কন্ট্রাক্টিং-এর ভার দিয়েছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ স্তরের নানা কোম্পানি, এমনকি এক-ব্যক্তি পরিচালনাধীন (স্বনিযুক্ত) সংস্থার হাতে। এই উৎপাদন-ব্যবস্থার জালিকা এতটাই বিশাল ও জটিল যে মূল বহুজাতিক কোম্পানিগুলি জানেই না তার মূল পণ্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলি কার কার হাতে উৎপাদিত হচ্ছে (ভারতে মারুতি, হোন্ডা কোম্পানিগুলি এইভাবেই চলে)। যাই হোক, ইতিমধ্যে এই ‘সাপ্লাই চেইনস’ গভীর মন্দার কবলে পড়েছে। আইএমএফ-এর ভাষায় যা ‘গ্লোবাল লকডাউন’, তার ফলে চাহিদা ব্যাপক হারে সংকুচিত হচ্ছে, অর্ডার কমছে। ফলে সরবরাহকারী (সাপ্লায়ার) দেশগুলির বড়-ছোট-অতিক্ষুদ্র শিল্প (যার মধ্যে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, মেক্সিকো, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ অগ্রগণ্য) ব্যাপক সংকটের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। (সূত্র ১৭) এককথায়, বিশ্ব অর্থনীতি প্রায় রুদ্ধ হতে বসেছে। সংকট এতটাই গভীর যে এপ্রিল মাসে বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল পিছু শূন্য ডলারে নেমে গিয়েছিল, যা ইতিহাসে আর কোনওদিন ঘটেনি।

কিন্তু এই মহাসংকটে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ কী করবে? অর্থনীতির চাকা সিকি বা আধা বন্ধ হয়ে গেলে তারা কি শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে মজুরি দেবে? নাকি বিনা খরচে খাবার-চিকিৎসা-জামাকাপড়-বাসস্থান-শিক্ষার বন্দোবস্ত করবে? শ্রেণি-সচেতন সর্বহারা সহ অনেকেই জানে বিশ্ব পুঁজিবাদ এর কোনওটাই করবে না। ইতিমধ্যে আমেরিকার মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশ তাদের দেশের কর্পোরেশনগুলিকে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার ভরতুকি দিতে শুরু করেছে। অন্যান্য দেশও যে একই পথে হাঁটবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ২০০৭-০৯ সালের সংকটের সময়ও তারা তাই করেছিল। তাদের নীতি হল পুঁজিপতিদের ভরতুকি দিলে তার কিছুটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে গরিব শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছাবে। বলা বাহুল্য, এর ফলে শ্রমিকদের যে কোনও সুরাহা হয়নি বা হতে পারে না ইতিহাসই তার সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৭০-এর দশকে নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদ (যার ‘সুযোগ্য’ নেতা ছিল রেগন ও থ্যাচার) বলেছিল এখন থেকে বাজারই সমস্ত কিছু নির্ধারণ করবে। সেই নয়া উদারনৈতিক মতাদর্শে অভিষিক্ত বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছিল বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণির উপর লাগাতার আক্রমণ। কারখানা বা ব্যবসাসংস্থাকে ছোটখাটো (slim and trim) করে আরও ‘দক্ষ’ করে তোলার ধুয়ো তুলে উন্নত দেশগুলি তো বটেই, সমগ্র বিশ্ব জুড়ে শ্রমিকশ্রেণির উপর আন্তর্জাতিক পুঁজির ছাঁটাই অভিযান চলেছিল, রাষ্ট্র যে সমস্ত জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা (কেইনস-এর অর্থনৈতিক মতবাদ অনুযায়ী) চালনা করত ক্রমে ক্রমে তা শ্রমিকশ্রেণির কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বিশেষত সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ধ্বংস করার পরিণামে বর্তমানে ব্রিটেন-ইতালি-স্পেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের কি দুরবস্থা হয়েছে তার কিছু চিত্র আমরা এই রচনার ষষ্ঠ অংশ আলোচনা করেছি। সুতরাং, বর্তমান মহাসংকটে বিশ্বের পুঁজিপতিরা যে তাদের সংকটের সমস্ত বোঝা সর্বহারা সহ সমগ্র গরিব মেহনতী জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএলও যে ভবিষ্যৎবাণী করেছে তার মধ্যে গরিব শ্রমজীবীর জন্য কোনও সুবার্তা যে থাকবে না তা তো বলা বাহুল্য।

ভারতবর্ষের শাসকবর্গও প্রায় একই ধরনের রাস্তা ধরেছে। ২৭ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রীদের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী রাজস্থানের কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করে বলেছেন, ‘‘আমাদের সংস্কার কর্মসূচীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।… আমাদের এই সংকটকে এক বিশাল মাপের সুযোগে পরিণত করতে হবে। আমি অশোক গেহলটকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।… তিনি শ্রমসময়কে বাড়িয়ে দিয়ে… পথ দেখিয়েছেন’’। (সূত্র ১৮) অনেকেই জানেন, রাজস্থান সরকার করোনা সংকটকে মোকাবিলা করার নামে শ্রমিকদের দৈনিক শ্রমসময় ৮ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টা করে দিয়েছে। একই পথ অনুসরণ করেছে আরও ছয়টি রাজ্যের সরকার। উপরন্তু, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাট সরকার তিনটি বাদে সমস্ত শ্রম আইন আগামী তিন বছরের জন্য বাতিল ঘোষণা করে দিয়েছে। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত এতটাই দানবীয় যে শ্রমসময় নির্ধারণ, ছুটি, ওভারটাইম নিয়মাবলী, মহিলা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত, তাদের রাত্রিকালীন কাজ, ক্যান্টিন সুবিধা, আগুন থেকে নিরাপত্তা, ফার্স্ট এইড, ইউনিয়ন গঠন, ইত্যাদি ব্যবস্থা চালু কারখানা, দোকান ও অফিসের শ্রমআইন থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এই অবস্থায় এমনকি বিজনেস স্টান্ডার্ডের মতো পুঁজিপতিশ্রেণির প্রথম সারির পত্রিকা মন্তব্য করছে: ‘শ্রমিকদের দাসে পরিণত করা হল’। (সূত্র ১৯)

প্রকৃতপক্ষে, ভারতে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার কিছু দিন পর থেকেই পুঁজিপতিশ্রেণির মুখপাত্ররা ‘এই সংকটকে সুযোগে পরিণত করা’র আহ্বান রেখেছিলেন। ইনফোসিস কর্তা নারায়ণ মূর্তি এপ্রিল মাসের শেষে বলেছিলেন, ‘‘আগামী ২-৩ বছর ভারতীয়দের সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা কাজ করা উচিত’’। (সূত্র ২০) কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা অরবিন্দ পানাগারিয়া সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, কোভিড-১৯ অতিমারি হল ‘‘দীর্ঘমেয়াদী ভাবনাচিন্তা করার সময়। এই সংকটকে নষ্ট করা খুবই দুঃখজনক। ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সংকট টিকে থাকবে।… করোনার ফলে বহুজাতিকরা বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাদের কার্যকলাপ প্রসারিত করতে চাইবে। ভারতের এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়।… এই সংকট সরকারের কাছে জমি ও শ্রম বাজারে সংস্কার চালু করার সুযোগ এনে দিয়েছে।’’ (সূত্র ২১) রিলায়েন্স কোম্পানির অর্থপুষ্ট অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন-এর সহ-সভাপতি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন, ‘‘সংকটের পরেই সংস্কার আসে।… কোভিড-১৯ হল সংস্কারের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত ঝটিকা। অর্থনৈতিকভাবে কোভিড-১৯ হল ১৯৯১ সালের সংস্কার। ভূরাজনৈতিকভাবে কোভিড-১৯ হল বালাকোট মুহূর্ত। সাংবিধানিকভাবে কোভিড-১৯ হল ৩৭০ নং ধারার অবলুপ্তি।… জমি, শ্রম এবং পরিকাঠামোর স্বাভাবিক সংস্কারগুলি আমাদের পিছনেই আছে। রাতারাতি, এই তিনটিকে… আমাদের সূচনাবিন্দু হিসেবে দেখতে হবে।… এই তিনটি প্রধান সংস্কারগুলির পক্ষে যুক্তি খুবই সাধারণ। ভারত চায় চাকরি। চাকরি সৃষ্টি হয় ব্যক্তিগত পুঁজির সাহায্যে। ব্যক্তিগত পুঁজি চায় এমন এক ব্যবসায়িক পরিবেশ যা তাদের উদ্যোগগুলির পক্ষে।’’ (সূত্র ২২) প্রবন্ধটির লেখক কীভাবে কোভিড-১৯ ‘‘ঝটিকা’’কে ব্যবহার করতে বলেছেন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এর কিছু পরেই ভারতের পুঁজিপতিদের তিনটি প্রথম সারির সংগঠন সিআইআই, ফিক্কি ও অ্যাসোচেম ২-৩ বছরের জন্য শ্রম আইন স্থগিত রাখার পরামর্শ সরকারকে দিয়েছিল। (সূত্র ২৩) ফলে কোভিড-১৯ সংকটকে কীভাবে পুঁজিপতিশ্রেণির শ্রেণিস্বার্থবাহী ‘‘সুযোগে’’ পরিণত করা যায়, তার জন্য শাসকবর্গ বদ্ধপরিকর।

প্রধানমন্ত্রী ১২ মে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে ২৭ বার ‘স্বনির্ভরতা’র কথা উচ্চারণ করেছেন। তাঁর ‘স্বনির্ভরতা’ বাণীর কয়েক দিনের মধ্যে কয়লা, খনিজ পদার্থ, প্রতিরক্ষা উৎপাদন, অসামরিক বিমান পরিবহণ, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ বণ্টন, পরমাণু শক্তি ও মহাকাশকে ব্যক্তিগত পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। এর ফলে আমবানি, আদানি, টাটা পাওয়ার, জেএসডবল্যু এনার্জি, বিড়লা গোষ্ঠীর হিন্দালকো, বেদান্ত অ্যালুমিনিয়াম, ইত্যাদিদের সামনে বিপুল ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়ে গেল। (সূত্র ২৪) তাৎপর্যপূর্ণ হল, এই ব্যাপক বেসরকারিকরণের ঘোষণা ছিল করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকার যে প্যাকেজ দিয়েছে তার অন্তর্ভুক্ত। এমনকি প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খল বা গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে ভারতকে যুক্ত করার ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের শক্ত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে’’। বলা বাহুল্য, এর অর্থ হল, শ্রমের ও জমির বাজারকে ব্যাপক পরিমাণে ‘সংস্কার’ করা – অর্থাৎ, শ্রমিকদের অত্যল্প মজুরি প্রদান, বেশি সময় ধরে খাটানো, শ্রমআইনকে বিলুপ্ত করে দেওয়া, জমি অধিগ্রহণ আইনকে লঘু করা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া, ইত্যাদি। না হলে চীনের সঙ্গে ‘‘প্রতিযোগিতা’’ হবে কীভাবে?

অর্থাৎ, করোনা সংকটের ‘সুযোগ’ কাজে লাগিয়ে অর্থনীতি ও শ্রমবাজারে ব্যাপক সংস্কার আনার মাধ্যমে সমস্ত সংকটের বোঝা গরিব শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে চাপানোর বন্দোবস্ত করা হল। জুন মাসের শেষার্ধে আইএমএফ জানিয়েছে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপির বৃদ্ধি তো হবেই না, বরং তা সংকুচিত হবে ৪.৫ শতাংশ – যা দেশের ইতিহাসে কোনওদিন ঘটেনি। (সূত্র ২৫) সি.এম.আই.ই.-র সর্বশেষ হিসেব থেকে জানা গেছে জুন মাসে ‘আনলক’ পর্যায় চালু হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৩ কোটি শ্রমিকের কোনও কাজ জোটেনি। অনুমিত হয়েছে যে, ব্যাপক পরিমাণ পরিযায়ী শ্রমিক গ্রামাঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে যে কোনও মজুরিতে ও যে কোনও শর্তে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে এবং তাদের পরিমাণ প্রায় ২ কোটি। (সূত্র ২৬) স্বাভাবিকভাবে ৮ ঘণ্টার স্থানে ১২ ঘণ্টার শ্রমসময় চালু করলে মজুত বেকারবাহিনীর স্ফীতকায় চেহারা আরও স্ফীতকায় হবে এবং সাধারণভাবে মজুরি কমবে – সি.এম.আই.ই. স্পষ্টভাবেই তা ব্যক্ত করেছে। (সূত্র ২৭) দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা/সংস্থাগুলি – যাদের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি, যারা দেশের মোট ম্যানুফাকচারিং শিল্পের ৪৫ শতাংশ উৎপাদন করে, দেশের রপ্তানির ৪০ শতাংশ যাদের মাধ্যমে ঘটে, দেশের জিডিপি-র ৩০ শতাংশ যে শিল্পগুলিতে কেন্দ্রীভূত এবং যারা মোট ১১ কোটি শ্রমিক নিয়োগ করে তারা এখন কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। (সূত্র ২৮) প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এদের অনেকেই বড় শিল্পের অনুসারী কিংবা সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে যুক্ত। জুন মাসে তাদের ৩৫ শতাংশ এবং স্বনিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির ৩৭ শতাংশ এক সমীক্ষায় জানিয়েছে যে তারা ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। (সূত্র ২৯) ৭২ শতাংশ জানিয়েছে তারা অবশ্যই শ্রমিক ছাঁটাই করবে। (সূত্র ৩০) বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা আগামীদিনে কী করতে চলেছে তার পূর্বাভাস এই দৃষ্টান্তে অত্যন্ত স্পষ্ট। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা কতটা গুরুতর তা সম্ভবত অচিরেই প্রকাশ পাবে। সাধারণভাবে অর্থনীতির চাকা না ঘুরলে তার সঙ্গে যুক্ত কোটি কোটি নানা পেশায় যুক্ত শ্রমজীবী এক সর্বনাশা ভবিষ্যতের সামনে পড়বে বা ইতিমধ্যে পড়ে গেছে তা বোঝা কঠিন নয়। অনাহারে মৃত্যু ও দুর্ভিক্ষও বোধহয় খুব বেশি দূরে নেই।

বর্তমান মহাসংকটের মধ্যে নিহিত আছে একাধিক সংকট। প্রথমত, বন্যপ্রাণি থেকে আগত কোভিড-১৯ ভাইরাস-ঘটিত সংকট। আগেই দেখেছি এই সংকট বাস্তুতান্ত্রিক সংকটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃতি তথা বাস্তুতন্ত্রের যে ফাটল বা বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়েছে তার মেরামত পুঁজিবাদে অসম্ভব, কেননা বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব বা বিরোধ চরম বা অসমাধানযোগ্য জায়গায় পৌছে গেছে।

দ্বিতীয়ত, এই মহাসংকটের মধ্যে আছে স্বাস্থ্যসংকট। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনও অবশিষ্ট আছে, (গুটিকয় দেশ বাদ দিয়ে) তার অবস্থা এতটাই গুরুতর যে সাধারণ সময়েই হাজার হাজার গরিব শ্রমজীবী মানুষের কাছে সুচিকিৎসা পৌঁছে দিতে তা হয় অক্ষম অথবা আধা-সক্ষম। এই অবস্থায় লাখ লাখ গরিব শ্রমজীবী মানুষের করোনা চিকিৎসা যে ক্রমশ অসম্ভবের দিকে যাচ্ছে তা অত্যন্ত পরিষ্কার। প্রকৃতপক্ষে, নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদ গত ৩০-৪০ বছর ধরে গণস্বাস্ছ্য-ব্যবস্থাকে যেভাবে ধ্বংস করেছে ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বেসরকারি/বহুজাতিক পুঁজির কাছে বিকিয়ে দিয়েছে, তার ফলে পুঁজিবাদের পক্ষে সাধারণ গরিব মানুষের কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাও এক অসমাধানযোগ্য বিরোধ।

তৃতীয়ত, ২০১৮-১৯ সাল থেকেই বিশ্ব অর্থনীতির মধ্যে মন্দার ছায়া ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল। করোনা-সংকট তার উপর খাঁড়ার ঘা মেরেছে। ফলে বর্তমানে আমরা যে সর্বশেষ বা অন্তিম পুঁজিবাদকে প্রত্যক্ষ করছি তা এক গভীরতম সংকটের মধ্যে পড়েছে। এক-একটি পুঁজিবাদী সংকটের অর্থ হল উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপক পরিমাণ বিনাশ, ব্যাপক বেকারি, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, তীব্র বৈষম্য, অনাহার ও দুর্ভিক্ষ, ইত্যাদি। এবারের সংকট সেই দিকেই এগোচ্ছে সম্ভবত ভয়াবহতম রূপ নিয়ে। অতীতে কখনও যুদ্ধবিগ্রহ করে, অর্থাৎ যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে পুঁজিবাদ তার সংকটকে সামাল দিয়েছে। কিংবা অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপে অঢেল অর্থ ঢেলে (যা প্রকৃতপক্ষে দেউলিয়া কোম্পানিগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা) অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এবারেও তারা সম্ভবত সেই রাস্তাই নেবে। কিন্তু এই মহাসংকটের ব্যাপ্তি এতটাই বিশাল বা তীব্র যে তা পুঁজিবাদকে বাঁচাতে পারবে কি না জানি না। কিন্তু উৎপাদিকা শক্তির অনিবার্য বিনাশ, প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংস, অভূতপূর্ব জীবনহানি, অনাহার, দুর্ভিক্ষের যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠছে, তার ফলে মানবসভ্যতা টিকবে কি না সেই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, পুঁজিবাদ এখন মানবসভ্যতার অগ্রগতির পক্ষে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদের মধ্যে বর্তমান সংকটের সমাধান নেই।

কিন্তু, বর্তমান বিশ্বে এই ঘোর বাস্তবতাকে স্বীকার করা বা উপলব্ধি করার মতো সচেতন আন্দোলনের বড় অভাব। সে আন্দোলন কীভাবে গড়ে উঠবে তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু পুঁজিবাদের অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং চরম বিশৃঙ্খল উৎপাদন ব্যবস্থাকে অপসারণ করে পরিকল্পিত, পরস্পর-সহযোগী, সমবায়ী, যৌথ প্রক্রিয়ায় এবং সামাজিক মালিকানায় পরিচালিত উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে না তুললে, প্রকৃতির সঙ্গে মানবসভ্যতার যে বিশাল ফাটল তৈরি হয়েছে পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে তাকে মেরামতের ব্যবস্থা গড়ে না তুললে, বাস্তুতন্ত্রের উপাদানগুলিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে, এবং এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সমাজ – ‘প্রত্যেকের কাছ থেকে তার সাধ্য অনুযায়ী নেবে ও প্রত্যেককে তার প্রয়োজন মতো দেবে’ – সেই রকম সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে না তুললে এই মানবসভ্যতাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থাটি হল সাম্যবাদের উচ্চতম পর্যায়। কোনও কোনও দেশে সাম্যবাদী লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্য নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও বিশ্বের কোনও দেশে তা এখনও বাস্তবায়িত করা যায়নি। তাই পরিস্থিতিটা এখন এমনই – হয় পুঁজিবাদী রাস্তায় চলে অবধারিতভাবে মানবসভ্যতা সহ এই গ্রহের বিনাশ মেনে নিতে হবে – অথবা উন্নত মানবসভ্যতা তথা সমাজতন্ত্রের দিকে এগোতে হবে। তীব্র ও বলিষ্ঠ বাস্তুতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া মানবসমাজের সামনে অন্য কোনও বিকল্প পথ আর খোলা নেই।

সূত্র:

১। ডেভিস, মাইক; ‘দ্য মনস্টার অ্যাট আওয়ার ডোর: দ্য গ্লোবাল থ্রেট অব এভিয়ান ফ্লু’, নিউ ইয়র্ক: দ্য নিউ প্রেস।

২। নরফিল্ড, টনি; ১১.০৬.২০২০, https://mronline.org/2020/06/11/viruses-imperialism/; ১২.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

৩। লেভিনস, রিচার্ড; সেপ্টেম্বর ২০০০, মান্থলি রিভিউ। চুনারা, জোসেফ; ২২.০৩.২০২০, http://isj.org.uk/socialism-in-a-time-of-pandemics/; ১২.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

৪। চুনারা, জোসেফ; ২২.০৩.২০২০, http://isj.org.uk/socialism-in-a-time-of-pandemics/; ১২.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

৫। ১৩.০৬.২০২০, https://timesofindia.indiatimes.com/india/community-transmission-of-covid-19-on-in-many-parts-of-india-icmr-survey-not-reflective-of-current-reality-experts/articleshow/76355865.cms; ৩০.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

৬। ১৭.০৭.২০, আনন্দবাজার পত্রিকা।

৭। ১৮.০৬.২০, https://www.weforum.org/agenda/2020/06/coronavirus-covid19-economic-recession-global-compared/; ২০.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

৮। ০৯.০৬.২০১৯, https://www.scmp.com/comment/opinion/article/3013604/brace-global-recession-unlike-any-other-amid-world-polarised-us-and; ২৯.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

৯। ১৬.১০.২০১৯, https://www.cnbc.com/2019/10/16/global-economy-awfully-high-chance-of-economic-recession-moodys-says.html; ২৯.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

১০। অক্টোবর, ২০১৯; মান্থলি রিভিউ।

১১। ৩০.০৬.২০২০, https://economictimes.indiatimes.com/news/international/business/global-labour-market-uncertain-no-return-to-pre-pandemic-levels-in-2020-ilo/articleshow/76712702.cms?from=mdr; ৩০.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

১২। ০৮.০৬.২০২০, https://www.worldbank.org/en/news/feature/2020/06/08/the-global-economic-outlook-during-the-covid-19-pandemic-a-changed-world; ২৪.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

১৩। পূর্বোক্ত।

১৪। ০৮.০৪.২০২০, https://economictimes.indiatimes.com/news/international/business/wto-forecasts-trade-plunge-in-2020-rebound-for-2021/articleshow/75050099.cms; ০৫.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

১৫। ২২.০৪.২০, https://countercurrents.org/2020/04/world-on-brink-of-a-hunger-pandemic-says-un-food-agency-chief; ২৩.০৪.২০-তে সংগৃহীত।

১৬। স্মিথ, জন; ইম্পিরিয়ালিজম ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি, নিউ দিল্লি: দেব পাবলিশার্স অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটর্স, পৃ: ১০১-০২।

১৭। জুন, ২০২০; মান্থলি রিভিউ, https://monthlyreview.org/2020/06/01/covid-19-and-catastrophe-capitalism/; ০২.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

১৮। ০২.০৫.২০২০, https://rupeindia.wordpress.com/2020/05/02/may-day-2020-and-the-creators-of-wealth/; ০৩.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

১৯। ০৮.০৫.২০, https://wap.business-standard.com/article-amp/economy-policy/up-govt-to-exempt-businesses-from-all-but-three-labour-laws-for-3-years-120050701531_1.html; ০৮.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

২০। ৩০.০৪.২০২০, https://www.thenewsminute.com/article/indians-should-work-60-hours-week-next-2-3-yrs-revive-economy-narayana-murthy-123661; ০১.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

২১। ২১.০৪.২০২০, https://news.rediff.com/commentary/2020/apr/21/dont-let-corona-crisis-go-waste-exadvisor-to-pm/5caf8991f9189866e8eae62dbee07d36; ১১.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

২২। ১০.০৪.২০২০, https://www.orfonline.org/expert-speak/covid-19-the-perfect-storm-for-deep-reform-64401/; ১১.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

২৩। ০৮.০৫.২০২০, https://economictimes.indiatimes.com/news/economy/policy/lockdown-hit-industry-demands-suspension-of-labour-laws-for-2-3-yrs/articleshow/75633578.cms?from=mdr; ১১.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

২৪। ১৬.০৫.২০২০, https://www.businesstoday.in/current/economy-politics/big-beneficiaries-of-tranche-iv-stimulus-adani-vedanta-tata-power-anil-ambani-reliance/story/404040.html; ১৭.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

২৫। ২৪.০৬.২০২০, https://indianexpress.com/article/business/economy/imf-india-economy-contraction-2020-6474451/; ২৪.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

২৬। ০৯.০৭.২০২০, https://www.newsclick.in/Job-situation-continues-to-be-grim-despite-unlock; ০৯.০৭.২০-তে সংগৃহীত।

২৭। ৩০.০৬.২০২০, https://economictimes.indiatimes.com/jobs/high-labour-supply-will-lead-to-drop-in-wages-in-urban-india-cmie/articleshow/76706344.cms; ৩০.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

২৮। ০৩.০৫.২০২০, https://indianexpress.com/article/business/economy/india-coronavirus-lockdown-economy-msme-6391186/; ০৩.০৫.২০-তে সংগৃহীত।

২৯। ০২.০৬.২০, https://www.newsclick.in/35-per-MSME-begun-shutting-shop-due-COVID-19-situation-survey; ০৫.০৬.২০-তে সংগৃহীত।

৩০। ০৫.০৬.২০২০, https://www.newsclick.in/over-70-per-MSME-intend-reduce-workforce-AIMO-survey; ০৫.০৬.২০-তে সংগৃহীত।