করোনা অতিমারি এবং পুঁজিবাদ (দ্বিতীয় অংশ)

By : Update Study Group | : 08 May, 2021
করোনা অতিমারি এবং পুঁজিবাদ (দ্বিতীয় অংশ)

ভারতে করোনার আবির্ভাব ধরা পড়ে জানুয়ারির ৩০ তারিখে। তাতে সরকারের টনক নড়েনি। এমনকি জানুয়ারির শেষে 'হু'-র থেকে সতর্কবার্তা শোনা গেলেও শাসকবর্গের কানে তা প্রবেশ করেনি। মার্চের ১১ তারিখে 'হু' অতিমারি ঘোষণা করলেও সরকারের হেলদোল ছিল না। বরঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকার ১৩ মার্চ ঘোষণা করে যে এখনও কোনও 'স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক জরুরি অবস্থা' সৃষ্টি হয়নি। (সূত্র ১) সে সময়ে সারা দেশে মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বার-গির্জায় হাজার হাজার ভক্তের আনাগোনা ছিল ষোল আনা। বিবাহের মরসুমে জনসমাগম ঘটল নির্বিচারে। মধ্যপ্রদেশে যে জমকালো ঘোড়া কেনাবেচার খেলা চলছিল তার সূত্রে লোকসভার অধিবেশনও জিইয়ে রাখা ছিল ২৩ মার্চ পর্যন্ত। ১৯ মার্চ, যখন ইউরোপ-আমেরিকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের বিপদঘণ্টি বেজে গেছে, তখন ঘোষিত হল 'আগামী রবিবার জনতা-কার্ফু'। তারপর, ২৪ মার্চ মাত্র চার ঘণ্টার প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দিয়ে, মানুষকে হঠাৎ চমকিত করে, ভক্তবৃন্দের বাহবা বাহবা ধ্বনিতে আপ্লুত সরকারের রথী-মহারথীরা অসংখ্য মানুষের রুটি-রুজির কোনও বন্দোবস্ত না করে দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে দিল।

পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রায় দেড় মাস কী ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে, এখনও তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে কীভাবে কার্যত খেলা করা হচ্ছে, কীভাবে হাঁটাপথে নিজ মুলুকে ফিরে যাওয়ার অসম্ভব তাড়নার ফলে রাজপথে মৃত্যুমিছিল অব্যাহত তা এক বিশেষ কাহিনী। প্রসঙ্গটি সম্পর্কে এই রচনার প্রথম অংশে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সে কাহিনী চলাকালীন, মার্চ মাসের একেবারে শেষদিকে মঞ্চস্থ হতে শুরু করল অন্য এক মহানাটক। ৩০ মার্চ নাগাদ দেশবাসীকে জানানো হল, দিল্লির নিজামুদ্দিনে 'তবলিগ জামাত' নামক এক মুসলমান ধর্মীয় জনসমাবেশ থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। সুতরাং, 'দেশবাসী সাবধান'!

কী ঘটেছিল দিল্লির নিজামুদ্দিনে? ১৩-১৫ মার্চ দিল্লিতে বিশ্বের মুসলমানদের একাংশের একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যাতে প্রায় ২-৩ হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল। বিদেশাগত প্রতিনিধিদের কেন্দ্রীয় সরকার ভিসা দিয়েছে। তারা সে ভিসা নিয়ে বিদেশে পাঠরত ও কর্মরত ভারতীয়দের সঙ্গে একযোগে দেশে প্রবেশ করেছে। সরকার তখন হয় নামকাওয়াস্তে জ্বর মেপেছে কিংবা বহিরাগত মানুষজনকে (কোয়ারান্টিনে না পাঠিয়ে) অবাধে জনসমুদ্রে মিশে যেতে দিয়েছে। যে ভবনে উক্ত সমাবেশ ঘটে তার ঠিক লাগোয়া ছিল পুলিশ-থানা এবং দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে সরকার কিছুই জানত না তা নির্বোধ ছাড়া আর কারোর বলার কথা নয়। ১৩ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকার 'স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক জরুরি অবস্থা' সৃষ্টি হয়নি বললেও দিল্লির আপ সরকার ঐ দিনই ২০০ জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ করে (বিবাহ অনুষ্ঠান ছাড়া)। তবে, অফিস-কাছারি, গণ পরিবহণ চলছিল। পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় তবলিগ সমাবেশ হচ্ছে আপ সরকারও তা জানত না বললে তাদের যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। যাই হোক, আপ সরকার ১৬ মার্চ ৫০ জনের বেশি জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা বসায়। (সূত্র ২) ততদিনে তবলিগ জমায়েত শেষ হয়েছে, অর্থাৎ চাইলে তখনই অংশগ্রহণকারীদের বিদায় জানানোর সুযোগ পূর্ণ মাত্রায় ছিল। অথচ কেন্দ্রীয় বা দিল্লি সরকার তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

এমনকি ১৮-১৯-২০ মার্চ পর্যন্ত দেশের বড় বড় মন্দিরে হাজার হাজার ভক্তের সমাবেশ হয়েছে। যেমন গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরে ১৮ ও ১৯ তারিখে পাঁচ হাজার করে। খোয়ালদাম মন্দিরে সাত হাজার করে। আমেদাবাদের ইস্কন মন্দিরে ১৮ তারিখে আট হাজার, ১৯ তারিখে দশ-বারো হাজার। দ্বারকা মন্দিরে ১৮-তে পাঁচ হাজার, ১৯-এ আড়াই-তিন হাজার। (সূত্র ৩) এছাড়া সিদ্ধিবিনায়ক ও মহাকালেশ্বর মন্দির ১৬ মার্চ পর্যন্ত খোলা ছিল। সির্দি সাইবাবা মন্দির ও শনি সিঙ্গাপুর মন্দির ১৭ মার্চ বন্ধ হয়। বৈষ্ণোদেবী মন্দির ১৮ মার্চ বন্ধ হয় এবং কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ২০ মার্চ পর্যন্ত খোলা ছিল। (সূত্র ৪) তিরুপতির মন্দিরও ২০ মার্চ পর্যন্ত চালু ছিল। এমনকি ২০ মার্চেও উত্তরপ্রদেশ সরকার ২৫ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত রামনবমী মেলা অনুষ্ঠানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। একমাত্র ২৪ তারিখে লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পরই তারা সে পরিকল্পনা ত্যাগ করে। (সূত্র ৫) পরে লকডাউনের মধ্যেই, ২৬ মার্চ, উত্তরপ্রদেশ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অযোধ্যায় তথাকথিত রাম জন্মভূমির অভ্যন্তরে রামলালার মূর্তি স্থাপন করেন সপারিষদে।

মার্চ মাসের তিরিশ তারিখ থেকে সঙ্ঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নেতানেত্রী, বিজেপি-র আইটি সেল এবং তাদের বশংবদ মিডিয়া তবলিগ সমাবেশ নিয়ে নানা ধরনের প্রচার শুরু করে। বলা বাহুল্য, এই প্রচারের অধিকাংশই মিথ্যা সংবাদ ('ফেক নিউজ')। দিল্লির বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক বি এল শর্মা বলেন, ''নিজামুদ্দিন... করোনা ভাইরাসের নয়া হটস্পট হয়ে উঠেছে''। (সূত্র ৬) ৩১ মার্চ একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক টুইট করেন, ''যদি #করোনাজেহাদ প্রকৃতই বাস্তব হয়ে থাকে তবে তার জরুরি তদন্ত করা উচিত''। (পূর্বোক্ত) প্রকৃতপক্ষে ২৮ মার্চ থেকেই হ্যাসট্যাগ #করোনাজেহাদ সামাজিক মাধ্যমে ভারত থেকে ৩ লক্ষ বার টুইট হয় এবং ১৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ তা দেখে। এছাড়া, 'করোনা-বোমা', 'মানব-বোমা', 'বিশ্বাসঘাতকতা', 'সন্ত্রাসবাদী' ইত্যাদি বহুবিধ উপাধিতে সমগ্র মুসলমান সমাজ ভূষিত হতে থাকে। (পূর্বোক্ত) বিজেপি-র জাতীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র বলেন, তবলিগ সমাবেশ হল ''অপরাধমূলক গাফিলতি''। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল ঐ সমাবেশকে ''বড় মাপের দায়িত্বহীন কাজ'' ঘোষণা করে তবলিগ প্রধান মৌলানা সাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে বলেন এবং দিল্লি পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ১৮৯৭ সালের এপিডেমিক আইন প্রয়োগ করে। (পূর্বোক্ত) ১ এপ্রিল থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিব লব আগরওয়াল প্রতিদিন সাংবাদিক সম্মেলনে দেশে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে তবলিগ জমায়েতকে দায়ী করেন। ৫ এপ্রিল তিনি বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ ৪.১ দিনে দ্বিগুণ হচ্ছে, নিজামুদ্দিনে জমায়েত না হলে তা ৭.৪ দিনে দ্বিগুণ হত। (সূত্র ৭) কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে তবলিগ সমাবেশকে করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী করার সাত দিন পর ৮ এপ্রিল 'হু'-র এমার্জেন্সি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মাইক রিয়ান বলেন, ''এতে কোনও লাভ হচ্ছে না। কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হওয়া কারোর দোষ নয়। প্রতিটি কেসই আমাদের কাছে আক্রান্ত স্বরূপ। আমরা জাতিগত, ধর্মীয় ও নৃকুলগত ভিত্তিতে কোনও কেসের বিচার করি না।'' (সূত্র ৮) তারপরেও কেন্দ্রীয় সরকার নড়ে চড়ে বসেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও ঐ সময়ে তবলিগ জামাতের আন্তর্জাতিক সমাবেশ করা যে অনুচিত বা দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হয়েছে যে কোনও সচেতন মানুষই তা বলবেন। কিন্তু তার জন্য ভারতের কুড়ি কোটি মুসলমান জনসমষ্টির প্রতি লাগাতার কুৎসা কেন চলবে? কেন একটি সমগ্র সম্প্রদায়কে করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী করা হবে এই প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কি?

যাই হোক। কুৎসার বন্যা বইতে থাকে। বিজেপি-র আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য ১ এপ্রিল বলেন, ''দিল্লির অন্ধকার জগত বিস্ফোরিত হয়েছে। শেষ তিন মাস জুড়ে সমস্ত ধরনের ইসলামি অভ্যুত্থান চলছে, প্রথমে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে, তারপর শাহিনবাগ থেকে জামিয়াতে, জাফরাবাদ থেকে সীলামপুরে। এখন র‍্যাডিকাল তবলিগি জামাতের বেআইনি সমাবেশে...।'' (সূত্র ৯) ৬ এপ্রিল বিজেপি সাংসদ শোভা করন্ডলাজে দাবি করেন, কর্নাটকের বেলাগাবি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া তবলিগ সদস্যরা নাকি থুতু ছেটাচ্ছে, হোটেল কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে, অভদ্রভাবে নাচছে ও অঙ্গভঙ্গি করছে। জেলা প্রশাসক এই অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই জানান। (পূর্বোক্ত) ৫ এপ্রিল হিন্দি দৈনিক অমর উজালা প্রচ্ছদ-নিবন্ধে লেখে যে, সাহারানপুরে কোয়ারান্টিনে থাকা জামাতিরা নাকি নিরামিষ খেতে অস্বীকার করেছে, খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, প্রকাশ্যে মলত্যাগ করেছে। এখানেও পুলিশ উক্ত দাবি নাকচ করে। (সূত্র ১০) মিথ্যা কথার চাষে অন্ত নেই। কোথাও মুসলমান ফলবিক্রেতা থুতু মাখিয়ে ফল বিক্রি করছে; কোথাও ''মোল্লারা বোতলে মূত্রত্যাগ করে সেই মূত্র ফলে ছড়িয়ে দিয়েছে ও গ্রেপ্তার হয়েছে''; কোথাও মুসলমান রুগীরা হাসপাতালে গোলযোগ করছে, ডিম ও বিরিয়ানি খেতে চাইছে; কোথাও মুসলমান সুফিরা সমবেত হাঁচি দিয়ে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঘটাচ্ছে! মিথ্যার বন্যা প্রকাশ করে চলেছে হিন্দুস্থান, এবিপি নিউজ, টিভি৯ গুজরাট, এস২৪ নিউজ চ্যানেল, ইন্ডিয়া টু ডে, ইত্যাদি, ইত্যাদি বহু সংবাদমাধ্যম। ন্যূনতম পক্ষে ৬৯টি জাল ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ জন তাতে শেয়ার করেছে, টুইট দেখেছে আড়াই লাখ। (পূর্বোক্ত) এমনকি 'বাম-ঘেঁষা' দ্য হিন্দু পত্রিকা কার্টুন এঁকেছে: সমগ্র বিশ্ব করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, যে ভাইরাসের পরনে মুসলমান পোশাক! (সূত্র ১১) এত তীব্র এই ঘৃণা, যেন মুসলমানরা নিজেরাই এক-একটি 'ভাইরাস'! ১৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে মুখ্য বিচারপতি বলেছেন, ''আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারি না''। (সূত্র ১২)

এর ফলাফলও হাতে নাতে ফলছে। তবলিগ প্রতিনিধিরাই করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে অভিযোগ তুলে কর্নাটকে বিজেপি এমএলএ এম পি রেনুকাচার্য খোলাখুলি ঘোষণা করেন, যারা স্বাস্থ্যপরীক্ষায় নারাজ হচ্ছে তাদের গুলি করে মারা উচিত। তিনি আরও বলেন, কোভিড ১৯ ভাইরাস যারা ছড়াচ্ছে, তারা সন্ত্রাসবাদী, তারা বিশ্বাসঘাতক। (সূত্র ১২) মহারাষ্ট্রের নব নির্মাণ সেনা-প্রধান রাজ ঠাকরেও ''বিশৃঙ্খল তবলিগ'' সদস্যদের গুলি করে মারার কথা বলেছেন। হিমাচল প্রদেশের বিজেপি প্রধান রাজীব বিন্দালের মতে, ''কিছু লোক, যেমন তবলিগ জামাত, মানব-বোমার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।'' এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দিল্লির কাছে দিলসাদ মেহবুব আলিকে নির্মমভাবে লাঠি-জুতো পেটাই করে ক্রুদ্ধ জনতা আওয়াজ তোলে, 'ওরা' করোনা-জেহাদের মাধ্যমে হিন্দুদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। (সূত্র ১৩) উত্তরাখণ্ডের হলদোয়ানিতে এলাকার লোকজন মুসলমান ফল-বিক্রেতাদের বিক্রিবাটা করার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। ম্যাঙ্গালোরের একটি গ্রামে মুসলমান বিক্রেতার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পোস্টার পড়েছে। (সূত্র ১৪) হরিয়ানা-দিল্লি সীমান্তে হরেয়ালি ও কুতুবগড় গ্রামে সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখানে থাকতে হলে হিন্দু রীতিনীতি মেনে চলতে হবে। অন্যথায় গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হবে। ব্যাঙ্গালোরে দু'জন মুসলমান সামাজিক কর্মী ত্রাণ বিলি করার সময়ে জনতা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। (সূত্র ১৫) প্রকৃতপক্ষে এই খবরগুলি হিমশৈলের চূড়া মাত্র। বাস্তবে যা ঘটছে তার ক'টাই বা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে?

ভুয়ো খবর প্রকাশ, জাল ভিডিও, এবং মুসলমানদের উপর লাগাতার হামলার প্রতিবাদে ১৯ এপ্রিল উপসাগরীয় দেশসমূহ, অর্থাৎ আরব দেশগুলি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ভারতে যেভাবে ''ইসলামোফোবিয়ার বন্যা বইছে'' এবং মুসলমানদের উপর আক্রমণ চলছে তার কড়া প্রতিবাদ জানায় তারা। (সূত্র ১৬) বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ঠিক তার পরেই, ঐ ১৯ এপ্রিলেই প্রধানমন্ত্রী টুইট করে বলেন, কোভিড ১৯-এর কোনও জাতি, ধর্ম, রঙ, বর্ণ, বিশ্বাস, ভাষা বা সীমান্ত ভেদ নেই। মানুষকে তাই ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। (সূত্র ১৭) আরব দেশগুলির তেলের উপর ভারতের নির্ভরতা, ঐ দেশসমূহে প্রায় ১ কোটি ভারতীয় কর্মরত, ফিবছর বিলিয়ন ডলারের আমদানি – এই সবের কথা ভাবতে হবে না? তবে প্রধানমন্ত্রী যাই বলুন, একুশ দিন ধরে লাগাতার মিথ্যা প্রচারের মধ্য দিয়ে যেভাবে গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কেই দাগি চিহ্নিত করা হল, সেই অপবাদ কি মোছা যাবে?

এটা ঠিক যে, তবলিগ সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের মধ্যে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এর কারণ অস্পষ্ট নয়। সরকার তবলিগ প্রতিনিধিদের নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করেছে, তাই সংক্রমণও ধরা পড়েছে। এই ধরনের নিবিড় পরীক্ষা যদি মন্দিরগুলোর হাজার হাজার ভক্তদের উপর কিংবা বিদেশাগত ভারতীয়দের উপর চালানো হত, তাহলে নিশ্চিতভাবে সংক্রমণের হার বেড়ে যেত। বিশেষত সরকার যেখানে নিজেই জানিয়েছে ৮০ শতাংশ রুগী উপসর্গহীন। অর্থাৎ উপসর্গহীন বহু আক্রান্তই যে সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে তাতে স্বাস্থ্যদপ্তর, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা একমত। (সূত্র ১৮)

করোনার আবির্ভাবের প্রথম থেকেই পশ্চিমি উন্নত দেশগুলি থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ভাইরাস ছড়ানোর জন্য চীনকে দায়ী করা হয়েছে। চীনের দিকে আঙুল তোলার পাশাপাশি ভারতে দায় চাপানো হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির মানুষজনের ঘাড়ে। যাদের প্রায়শই 'চিঙ্কি', 'মোমো' বিদ্রূপে অভিষিক্ত করা হয়, তাদের উদ্দেশ্যে রাস্তাঘাটে উড়ে এসেছে 'করোনা ভাইরাস' কটু মন্তব্য, এমনকি নিগ্রহ। (সূত্র ১৯) অবশ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের প্রতি জাতিগত ঘৃণার বর্ষণ নতুন কিছু নয়। বহুদিন ধরেই তা অব্যাহত আছে।

ভারতের বা বিশ্বের মানুষকে বারবার জানানো হয়েছে, 'সামাজিক দূরত্ব' বজায় রাখুন। কথাটি খুবই অর্থবহ। অন্তত ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে। ভারতে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন দলিত বা আদিবাসী। উচ্চবর্ণের কাছে তারা অস্পৃশ্য। তারা থাকে গ্রামের বাইরে বা শহরের কিনারায়, বস্তি বা ঘেটোয়, কিংবা পাহাড়-জঙ্গলে। বর্ণহিন্দুর বর্জ্য দ্রব্য দলিত (অতিশূদ্র) মানুষ বহু ক্ষেত্রে খালি হাতে বহন করতে বাধ্য হয়। উচ্চবর্ণ হিন্দু যাতে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, উৎকৃষ্ট, সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, সৃষ্টিশীল থাকতে পারে সেই 'সুমহান' লক্ষ্যে দলিতদের জন্য নিকৃষ্ট কাজগুলি বরাদ্দ। সংখ্যায় তারা প্রায় ২১ কোটি। একই কথা প্রযোজ্য আদিবাসী মানুষের ক্ষেত্রেও। প্রায় সাড়ে এগারো কোটি এই প্রান্তজ মানুষরা বাবুদের কাছে জংলি, অসভ্য বা বর্বর। উচ্চবর্ণ হিন্দু বাবু-ভদ্রলোক সম্প্রদায় প্রতি পদে অতি সন্তর্পণে এই সাড়ে বত্রিশ কোটি দলিত-আদিবাসী মানুষকে 'সামাজিকভাবে' বহু বহু 'দূরত্বে' রেখে দিয়েছে। বর্ণব্যবস্থার বাইরে থাকা এই মানুষরা অবশ্য মাঝেমাঝে উচ্চ বর্ণের জন্য বরাদ্দ অংশে ভাগ বসাতে চায়। তখন তাদের মেরেধরে, পিটিয়ে, খতম করে, তাদের নারীদের গণধর্ষণ করে বেয়াদপির শাস্তি দেওয়া হয়। এছাড়া বর্ণব্যবস্থার সবচেয়ে নীচু স্তরে আছে আরও প্রায় একচল্লিশ কোটি শূদ্র। (সূত্র ২০) এদের জন্মনির্দিষ্ট কর্তব্য হল উচ্চবর্ণের সেবা করা। এরাও তো তথাকথিত উচ্চ বর্ণ সমাজের কাছে প্রান্তিক মানুষ। 'সামাজিকভাবে' ব্রাত্য, নীচু জাতভুক্ত এবং উচ্চ বর্ণের 'আভিজাত্য-মানমর্যাদা' থেকে বহু 'দূরে' থাকা শূদ্র মানুষ। তবে পুঁজিবাদী বিকাশের সূত্রে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে একটি উপরিস্তর, যারা এখন উচ্চবর্ণ ভদ্রলোকের মতো দলিত-আদিবাসীদের থেকে 'দূরত্ব' বজায় রাখতে উৎসাহী। তারপর আছে কুড়ি কোটি মুসলমান জনগণ। 'গোমাংসভোগী, স্বভাবতই নোংরা, নিকৃষ্ট, সংস্কৃতিহীন, গন্ধা'দের সঙ্গে উচ্চবর্ণ বাবু-ভদ্রলোকের কোনও তুলনাই চলে না! মূলত ঘন বসতিসম্পন্ন বস্তি-ঝুপড়ি-ঘেটোয় তাদের স্থান করে দেওয়া হয়েছে। এরাই হল সেই বিখ্যাত ''ওরা'' (others), যাদের উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মতো অনেকেই ঘৃণা করে, তাদের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলে, মুসলমান মানেই 'পাকিস্তানি', কিংবা 'সন্ত্রাসবাদী' এমন একটি পরিচয় সজোরে তাদের গায়ে গেঁথে দেয়। এই তো আমাদের ভারতবর্ষ। এখানে 'সামাজিক দূরত্ব' অতি স্বাভাবিক এক ঘটনা। জন্মজন্মান্তর কাল ধরে এই 'সামাজিক দূরত্ব' বজায় রাখা হয়েছে।

তাই, করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য যখন 'সামাজিক দূরত্ব' সৃষ্টি করার কথা বলা হয়, তাতে উচ্চ বর্ণভুক্ত মানুষের কোনও অসুবিধা না-হলেও, বস্তি/ঝুপড়ি/ঘেটোয় সর্বাধিক দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে গাদাগাদি করে থাকা অন্ত্যজ 'দূরের' মানুষগুলোর কাছে তা যেন হয়ে ওঠে শতাব্দীর নির্মম রসিকতা!

তবে, সামাজিকভাবে দূরে রাখার চলতি প্রথার সঙ্গে যখন মিশ্রিত হয় হিন্দুত্ববাদী বা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ, তখন যে ককটেল প্রস্তুত হয়, তা বিদ্যমান 'সামাজিক দূরত্বকে' করে তোলে আরও ভয়াবহ। এর মাধ্যমে যখন যেমন সুবিধা সেই অনুযায়ী যে কোনও সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, জনসমষ্টিকে গণশত্রু করে তোলা যায়। সমাজে দেখা দেওয়া যে কোনও সংকটের জন্য (যেমন এখন অতিমারি) কোনও এক গোষ্ঠীকে দায়ী করে বাকি অংশের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে 'যথোপযুক্ত ব্যবস্থা' নেওয়ার জন্য উন্মাদনা সৃষ্টি করা যায় – যা এখন ভারতে চলছে। ইহুদি গোষ্ঠীকে পশ্চিমি দেশগুলি গত বিশ্বযুদ্ধের বহু আগে টার্গেট করে রেখেছিল। জার্মানিতে নাৎসিবাদ উক্ত গোষ্ঠীকে কীভাবে গণশত্রু আখ্যা দিয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্বিচারে খুন করেছে, 'আর্য' জার্মান সভ্যতা-সমাজকে 'নিষ্কলুষ' রাখতে চেয়েছে তার ঘৃণ্য সাক্ষ্য ইতিহাসে এখনও জ্বলজ্বল করছে। ইতিমধ্যে আমেরিকা, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ইত্যাদি দেশসমূহে করোনা ভাইরাসের ধারক-বাহক হিসেবে চীনা, এশিয়ান বংশোদ্ভূত, কালো বা আফ্রিকান মানুষ, কিংবা 'বেআইনি অনুপ্রবেশকারী' এবং উদ্বাস্তুদের গণশত্রু করে তোলার প্রক্রিয়া তীব্রতর হচ্ছে। পুঁজিবাদী দুনিয়া নিজেদের অপরাধকে ঢাকতে এর থেকে বেশি আর কী করতে পারে সেটা আগামী দিনে ক্রমশ প্রকাশিত হবে।

ভারতের শাসকবর্গ অনুরূপ পথ ধরেছে। ফ্যাসিবাদী শাসন স্থাপনের পক্ষে অতিমারিকে ব্যবহার, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে গণশত্রু করে তোলা – এই কাজে তারা বেশ তরতর করে এগোচ্ছে। তবে অতিমারির ধাক্কায় অর্থনৈতিক সংকট গভীরতম হলে, কোটি কোটি মানুষ রুটি-রুজি হারালে, দেশ মন্বন্তর বা বুভুক্ষার মুখে পড়লে শাসকবর্গ তাদের ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী কীভাবে প্রয়োগ করে তা আগামী দিনে দেখা যাবে। বিশেষত অতিমারির অজুহাতে শাসকবর্গ কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও ধারালো করে তুলছে সে প্রসঙ্গে আলোচনা পরের অংশে।

(লেখা ক্রমশ বড় হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা নির্ধারিত দ্বিতীয় অংশকে দু'টি ভাগে ভাগ করেছি। আশা করি দ্বিতীয় ভাগটি দ্রুত প্রকাশ করতে পারব।)   

সূত্র:

১) ১৩.০৩.২০; https://www.business-standard.com/article/pti-stories/coronavirus-cases-rise-to-81-in-india-officials- 120031301149_1.html; ২৪.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

২) ০১.০৪.২০; https://thewire.in/communalism/covid-19-tablighi-jamaat-hindu-muslim; ০১.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

৩) ০২.০৪.২০; https://ahmedabadmirror.indiatimes.com/ahmedabad/cover-story/sick-ular-in-times-of-corona/articleshow/ 74939907.cms; ২০.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

৪) ১৩.০৪.২০; https://theprint.in/opinion/indian-media-waging-holy-war-against-muslims-hyenas/400407/; ১৩.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

৫) সূত্র ২ দ্রষ্টব্য।

৬) ২১.০৪.২০; https://scroll.in/article/959806/covid-19-how-fake-news-and-modi-government-messaging-fuelled-indias-latest-spiral-of-islamophobia; ০২.০৫.২০-এ সংগৃহীত।

৭) ০১.০৫.২০; https://countercurrents.org/2020/05/fake-news-targeting-muslims-exposed-by-police-but-still-aired-and-that-even-by-mainstream-media; ০২.০৫.২০-এ সংগৃহীত।

৮) সূত্র ৬ দ্রষ্টব্য।

৯) সূত্র ২ দ্রষ্টব্য।

১০) সূত্র ৭ দ্রষ্টব্য।

১১) ১৪.০৪.২০; https://theintercept.com/2020/04/14/coronavirus-muslims-islamophobia/; ২৪.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

১২) সূত্র ৭ দ্রষ্টব্য।

১২) ০৮.০৪.২০; https://scroll.in/article/959364/the-aarogya-setu-app-endorsed-by-modi-to-track-covid-19-cases-could-ramp-up-government-surveillance; ২২.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

১৩) ২২.০৪.২০; https://mronline.org/2020/04/22/bjp-capitalizes-on-coronavirus-fears-to-take-indias-fascist-creep-to- the-next-level/; ২৩.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

১৪) ০৯.০৪.২০; https://theprint.in/opinion/covid-an-excuse-to-push-indian-muslims-out-of-informal-sector-jobs-apartheid-the-next-step/398236/; ০৯.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

১৫) ১৯.০৪.২০; https://www.newsclick.in/Sectarianism-Regime-Default-Mode-Misdirection; ১৯.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

১৬) সূত্র ৭ দ্রষ্টব্য।

১৭) ২০.০৪.২০; https://thewire.in/communalism/indias-coronavirus-related-islamophobia-has-the-arab-world-up-in-arms; ২৪.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

১৮) ২১.০৪.২০; https://economictimes.indiatimes.com/industry/healthcare/biotech/healthcare/no-symptoms-in-80-of-covid-cases-raise-concerns/articleshow/75260387.cms?from=mdr; ২৪.০৪.২০-এ সংগৃহীত।

১৯) ২৩.০৩.২০; https://www.newsclick.in/amid-coronavirus-outbreak-people-northeast-battle-racist-slurs-and-xenophobia; ২৮.০৩.২০-এ সংগৃহীত।

২০) সঙ্ঘ পরিবার ও হিন্দুত্ববাদ: ভিত্তি উদ্ভব বিকাশ, আপডেট স্টাডি গ্রুপ, ২০২০, কলকাতা: সেতু প্রকাশনী, পৃঃ ২৮১-৮২।